Wednesday, July 30, 2025

ক্ষুধার্ত মানুষের রক্তে রঞ্জিত গাজা, ইসরায়েলি হামলায় ৬৭ জন নিহত

Date:

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, রবিবার উত্তর গাজায় জাতিসংঘের ত্রাণ ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এমন অন্তত ৬৭ জন ফিলিস্তিনি ইসরায়েলি গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। একই সময়ে, ইসরায়েল নতুন করে গাজার ঘনবসতিপূর্ণ ও বাস্তুচ্যুতিতে পূর্ণ এলাকাগুলো খালি করার নির্দেশ দিয়েছে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, এই ঘটনায় বহু মানুষ আহত হয়েছেন। সাম্প্রতিক সময়ে ত্রাণ সংগ্রহের সময় হামলার শিকার হয়ে নিহতের সংখ্যা এটিই সর্বোচ্চ। এর আগের দিনও একই ধরনের ঘটনায় ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছিল। দক্ষিণ গাজার আরেকটি ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে আরও ৬ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, রবিবার উত্তর গাজায় হাজারো মানুষের ভিড়ের দিকে তারা সতর্কতামূলক গুলি ছুড়েছিল, কারণ তারা তাৎক্ষণিক হুমকি অনুভব করেছিল। সেনাবাহিনীর ভাষ্য, নিহতের সংখ্যা বাড়িয়ে বলা হতে পারে এবং তারা ইচ্ছাকৃতভাবে কখনোই ত্রাণবাহী যানবাহনকে লক্ষ্যবস্তু বানায় না। তবে দক্ষিণ গাজার ঘটনার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি তারা।

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, তাদের ২৫টি খাদ্যবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশের পরপরই ক্ষুধার্ত মানুষের বিশাল ভিড়ের মুখে পড়ে এবং তখনই সেখানে গুলি চলে। ডব্লিউএফপি বলেছে, ত্রাণের আশায় আসা বেসামরিক মানুষের ওপর সহিংসতা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

হামাসের এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছেন, ক্রমবর্ধমান মৃত্যুর সংখ্যা ও খাদ্য সংকটে তারা ক্ষুব্ধ এবং এটি কাতারে চলমান যুদ্ধবিরতি আলোচনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, রবিবার গাজা জুড়ে ইসরায়েলি গুলিবর্ষণ ও বিমান হামলায় মোট ৯০ জন নিহত হয়েছেন।

বাস্তুচ্যুতদের নতুন করে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ

কেন্দ্রীয় গাজার দেইর আল-বালাহ এলাকায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী লিফলেট ছড়িয়ে বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে বলার পর, স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ওই এলাকায় তিনটি বাড়িতে বিমান হামলা হয়েছে। অনেক পরিবার তাদের সামান্য জিনিসপত্র নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। এই এলাকায় কয়েক লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, চলমান সংঘাতে তারা এখনো ওই এলাকায় প্রবেশ করেনি, তবে শত্রুর সক্ষমতা ও সন্ত্রাসী অবকাঠামো ধ্বংসে তারা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি সূত্রের দাবি, ওই এলাকায় হামাস জিম্মিদের আটকে রেখেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। গাজায় এখনো অন্তত ৫০ জন জিম্মির মধ্যে ২০ জন জীবিত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

জিম্মিদের পরিবারের সদস্যরা সেনাবাহিনীর কাছে জানতে চেয়েছেন, এই সিদ্ধান্তে তাদের প্রিয়জনদের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে কিনা।

ক্ষুধা ও মানবিক সংকট চরমে

দীর্ঘ ২১ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধে গাজার অধিকাংশ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। খাদ্য সংকট চরমে পৌঁছেছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, খাদ্যের অভাব ও ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শত শত মানুষ দুর্বলতা ও মাথা ঘোরার কারণে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন এবং তাদের অনেকেই মৃত্যুর মুখে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সতর্ক করেছে, অপুষ্টিতে ভোগা শত শত মানুষ যে কোনো সময় ক্ষুধায় মারা যেতে পারে। জাতিসংঘও জানিয়েছে, গাজায় মানুষ অনাহারে ভুগছে এবং জরুরি ভিত্তিতে ত্রাণ প্রয়োজন।

পোপ ফ্রান্সিস গাজায় একমাত্র ক্যাথলিক গির্জায় ইসরায়েলি হামলায় তিনজন নিহত হওয়ার ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

গাজার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার, বিশেষ করে ময়দা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলমান যুদ্ধে অন্তত ৭১ শিশু অপুষ্টিতে মারা গেছে এবং আরও ৬০,০০০ শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। রবিবার আরও ১৮ জন ক্ষুধায় মারা গেছেন।

খাদ্যের দাম এত বেড়ে গেছে যে, অধিকাংশ মানুষ তা কিনতে পারছেন না। রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অনেকেই জানিয়েছেন, তারা গত ২৪ ঘণ্টায় একবেলা বা কোনো খাবারই পাননি।

একজন নার্স জিয়াদ বলেন, “আমি প্রতিদিন সকালে উঠে খাবারের খোঁজে বের হই, অন্তত পাঁচ সন্তানের জন্য এক টুকরো রুটির জন্য, কিন্তু কিছুই পাই না। যারা বোমায় মারা যায়নি, তারা ক্ষুধায় মারা যাবে। আমরা এখনই যুদ্ধবিরতি চাই, অন্তত দুই মাসের জন্য হলেও।”

অনেকে জানিয়েছেন, রাস্তায় হাঁটার সময় মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছেন, অনেকেই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। বাবারা সন্তানদের খাবার চাওয়ার প্রশ্ন এড়াতে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে যান।

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) জানিয়েছে, তাদের কাছে গাজার জন্য তিন মাসের খাবার মজুত আছে, কিন্তু ইসরায়েল তা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। তারা আরও বেশি ত্রাণ ট্রাক প্রবেশের অনুমতি চেয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশ করানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে তারা তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে।

যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা

কিছু ফিলিস্তিনি মনে করছেন, দেইর আল-বালাহ এলাকায় সরিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপটি হামাসকে যুদ্ধবিরতি আলোচনায় আরও ছাড় দিতে চাপ দেওয়ার কৌশল হতে পারে। ইসরায়েল ও হামাস দোহায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি বিনিময় চুক্তির বিষয়ে পরোক্ষ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, যদিও কোনো অগ্রগতির খবর নেই।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস-নেতৃত্বাধীন যোদ্ধারা ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ১,২০০ জনকে হত্যা করে এবং ২৫১ জনকে গাজায় জিম্মি করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে ইসরায়েলি অভিযানে গাজায় ৫৮,০০০-এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, প্রায় পুরো জনসংখ্যা বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং অঞ্চলটি চরম মানবিক সংকটে পড়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

spot_imgspot_img

Popular

More like this
Related

মাদকবিরোধী অভিযানে নীলফামারীতে কুখ্যাত বাশার আটক, পলাতক আরও দুই

আশীষ বিশ্বাস নীলফামারী প্রতিনিধি : নীলফামারীতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের...

টেকনাফে র‍্যাবের সফল অভিযান: শীর্ষ সন্ত্রাসী শফি ডাকাত অস্ত্র-মাদকের পাহাড়ে আটক

ফরহাদ রহমান, টেকনাফ প্রতিনিধি টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২৬ এর পাহাড়ি...

জেএসএস’র হাল ধরলেন আছিয়া আক্তার

“জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা”র হাল ধরলেন প্রতিষ্ঠাতার সহধর্মিণী মোছা: আছিয়া...

সান্তাহারে ট্রেন দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু

সান্তাহারে ট্রেন দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু মৌ আকতারঃবগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার...