যুদ্ধ, অবরোধ আর মানবিক বিপর্যয়ে ভেঙে পড়ছে গাজার জনজীবন। ইসরাইলি হামলা ও নিষেধাজ্ঞার কারণে খাদ্য সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। জাতিসঙ্ঘ-সমর্থিত সংস্থা ‘আইপিসি’ আশঙ্কা প্রকাশ করে জানিয়েছে, গাজা উপত্যকার প্রায় ২১ লাখ মানুষ এখন দুর্ভিক্ষের ‘গুরুতর ঝুঁকিতে’।
মঙ্গলবার (১৩ মে) বিবিসির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ‘ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন’ (IPC)-এর সর্বশেষ জরিপে এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে। এই সংস্থাটি জাতিসঙ্ঘ, বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের সরকারগুলোর সমন্বয়ে গঠিত, যারা কোনো অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা রয়েছে কিনা— তা পর্যালোচনা করে আন্তর্জাতিক মহলকে সতর্ক করে থাকে।
অবরোধ আর সহায়তার ঘাটতিতে ভয়াবহ মানবিক সংকট
আইপিসির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে গাজার খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি ধারাবাহিকভাবে খারাপের দিকে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় ১৯ লাখ ৫০ হাজার মানুষ, অর্থাৎ গাজার ৯৩ শতাংশ জনগণ, তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার। এর মধ্যে প্রায় ২ লাখ ৪৪ হাজার মানুষ রয়েছেন সবচেয়ে বিপর্যস্ত স্তরে, যাদের প্রতিদিনই ক্ষুধার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।
গাজায় খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য মানবিক সহায়তা প্রবেশে ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদি বাধা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। মার্চের শুরু থেকে ইসরাইল পুনরায় সামরিক অভিযান শুরু করার পর মানবিক ত্রাণ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। এতে করে সেখানে এক ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি হয়েছেন বাসিন্দারা।
যুদ্ধবিরতির পরেও থেমে নেই সংকট
যুদ্ধবিরতির সময় কিছুটা স্বস্তি মিললেও নতুন করে সহিংসতা শুরু হওয়ায় আশঙ্কা বেড়েছে গাজাবাসীর মধ্যে। আইপিসির তথ্য অনুযায়ী, গাজায় এমন কিছু পরিবার আছে, যারা খাবারের জন্য ভিক্ষা করছে, ময়লা-আবর্জনা থেকে খাওয়ার যোগ্য কিছু খুঁজে নিচ্ছে কিংবা আবর্জনা বিক্রি করে খাদ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছে।
জাতিসঙ্ঘ আশঙ্কা করছে, এ সংকট দীর্ঘ হলে ২০২৬ সালের এপ্রিলের মধ্যে গাজার পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৭১ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগতে পারে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ভয়াবহ হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও বাধা
ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ এখনো গাজায় দুর্ভিক্ষের শঙ্কা মানতে নারাজ। তাদের দাবি, যুদ্ধবিরতির সময় ‘যথেষ্ট পরিমাণে’ ত্রাণ ঢুকেছে। তবে জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এর তীব্র বিরোধিতা করছে। জাতিসঙ্ঘ জানিয়েছে, তারা গাজা সীমান্তে বিপুল পরিমাণ মানবিক সহায়তা প্রস্তুত রেখেছে, কিন্তু ইসরাইল বাধা না দিলে সেগুলো প্রবেশ করাতে এক মুহূর্তও সময় লাগবে না।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ইসরাইলের এই অবরোধ ও খাদ্য সরবরাহে বাধা এক ধরনের ‘অনাহারে রাখার নীতি’, যা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
গোপন সমঝোতা ও জটিল কূটনীতি
হামাসের একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা ইসরাইলের সঙ্গে নতুন একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে চায়, যাতে গাজায় খাবার, ওষুধ এবং মানবিক ত্রাণ ঢুকতে পারে। সোমবার গাজার সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস এক মার্কিন-ইসরাইলি পণবন্দী এডান আলেক্সান্ডারকে মুক্তি দিয়েছে, যা নতুন আলোচনার সম্ভাবনার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ইসরাইল বলছে, তারা এখনও কোনো যুদ্ধবিরতির প্রতিশ্রুতি দেয়নি, বরং শুধুমাত্র একটি ‘নিরাপদ করিডোর’ নিয়ে ভাবছে। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরকালে চুক্তিতে পৌঁছানো না গেলে গাজায় আরও বড় সামরিক আক্রমণের হুমকি দিয়েছে ইসরাইল। এমনকি গাজা উপত্যকার বেশির ভাগ এলাকা দখল এবং বেসরকারি ত্রাণ সংস্থার বদলে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব নিজেরা নেওয়ার কথাও বলছে তারা।
গাজার ভেতরে জীবনের জন্য লড়াই
গাজায় এখন যেন প্রতিটি দিন বেঁচে থাকার লড়াই। শিশু, বৃদ্ধ, নারী ও অসহায় মানুষজন অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। প্রতিনিয়ত বোমা, ক্ষুধা ও অনিশ্চয়তা ঘিরে রেখেছে তাদের জীবন।
আইপিসির সর্বশেষ মূল্যায়ন অনুযায়ী, এই পরিস্থিতি বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ মানবিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। দ্রুত আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া গাজায় দুর্ভিক্ষ পুরোপুরি বাস্তবতায় রূপ নিতে পারে।