Thursday, July 31, 2025

“ড্যান্ডি আসক্তিতে বিপর্যস্ত পথশিশুরা” উপায় কি?

Date:

পত্রিকার পাতায় প্রতিদিনই উঠে আসছে মর্মান্তিক সব ঘটনা—নেশার টাকা না পেয়ে সন্তান খুন করছে মা-বাবাকে, স্বামী হত্যা করছে স্ত্রীকে। মাদকাসক্তদের দ্বারা সংঘটিত চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েই চলেছে। নেশার অর্থ জোগাড় করতে গিয়ে তারা যে কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছাড়াই।

 

ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বুড়িগঙ্গা নদী। নদীর বেড়িবাঁধ ঘেঁষেই রয়েছে একটি ছোট ছাউনি, যা আশ্রয় হয়ে উঠেছে ১২ থেকে ১৫ জন পথশিশুর। সারাদিন তারা বিভিন্ন জায়গা থেকে ভাঙারি সংগ্রহ করে, আর সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে এই অস্থায়ী আশ্রয়ে। কিন্তু দিনের শেষে তাদের আচরণ চোখে পড়ে দুঃখজনক ও আশঙ্কাজনক এক প্রবণতা—বেশিরভাগই মুখে পলিথিন চেপে ধরে কিছু একটা শ্বাস নেয়।

জিজ্ঞেস করলে সুজন নামে এক শিশু হেসে বলে ওঠে, “ড্যান্ডি লইতে লইতে জীবনটা প্লাস্টিক হইয়া গেছে।” তার কথায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তারা ‘ড্যান্ডি’ নামক এক ধরনের কেমিক্যাল দিয়ে নেশায় জড়িয়েছে। এই দৃশ্য সমাজের অপ্রিয় এক বাস্তবতাকে সামনে আনে—দারিদ্র্য, অবহেলা এবং সহায়তা না থাকায় পথশিশুরা বিপজ্জনক নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে।

সম্প্রতি ‘ড্যান্ডি’ নামে নতুন ও সহজলভ্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে বেশিরভাগ পথশিশু। সহজলভ্য বলে পথশিশুরাই এ মাদকে আসক্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ড্যান্ডি এক ধরনের আঠা, যা মূলত সলিউশন নামে পরিচিত। এতে টলুইন নামে এক প্রকার উপাদান থাকে। টলুইন মাদক দ্রব্যের তালিকায় আছে। এটি জুতা তৈরি ও রিকশার টায়ার টিউব লাগানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। এই আঠা পলিথিনের মধ্যে রেখে নিঃশ্বাস নিলে এক ধরনের নেশা হয়। এর ফলে ক্ষুধা ও শরীরের যন্ত্রণা অনুভূত হয় না। দীর্ঘমেয়াদে এ নেশা শরীরের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। শিশুদের ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি।

সমাজে বসবাসরত অনেক শিশু এই ভয়াল নেশার ফাঁদে আটকা পড়েছে। এটি থেকে বের হতে পারছে না। মনোরোগ ও মাদকাসক্তি চিকিৎসাবিদদের মতে, বস্তির শিশু, রাস্তার টোকাই এবং যারা মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তাদের সন্তানেরা আগে মাদক নিত। এখন সমাজের অভিজাত শ্রেণির ছেলেমেয়েরাও মাদক নিয়ে থাকে। সাধারণত ১২ থেকে ১৫ বছর বয়সী শিশুদের মাদক গ্রহণের হার বেশি। শুরুতে তারা বলে, নেশা করব না, শুধু একটু খেয়ে দেখি। কিন্তু একপর্যায়ে তারা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। স্বাভাবিক জীবন হারিয়ে ফেলে। মাদকসেবীরা অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে। পথশিশুরা রাস্তায় বড় হয়। মাদকই তাদের একমাত্র বিনোদন।

 

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের ক্ষেত্রে এটি নিরাময়যোগ্য, তবে সময় সাপেক্ষ। সরকারি পর্যায়ে শিশুদের মাদকাশক্তি প্রতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। মাত্র ৪টি সরকারি নিরাময় কেন্দ্র আছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তবে মাদকাসক্ত শিশুদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন অব বাংলাদেশ (সিএসপিবি) শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় কিছু স্থানে ড্রপ ইন সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে মাদকাসক্ত শিশুদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।

মাদক নির্মূল শুধুমাত্র সরকারের একক দায়িত্ব নয়; এটি একটি সামগ্রিক সামাজিক চ্যালেঞ্জ, যার মোকাবেলায় সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। মাদকের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে হবে স্কুল, পরিবার ও গণমাধ্যমসহ সবক্ষেত্রে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের নৈতিক মূল্যবোধ গঠনে অভিভাবকদের পাশাপাশি শিক্ষকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।

মাদকাসক্ত শিশু-কিশোরদের সমাজের মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে পরিবারের সদস্যদের সহানুভূতিশীল, উৎসাহব্যঞ্জক এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ অত্যন্ত জরুরি। যেসব শিশু-parentহীন বা সুবিধাবঞ্চিত, তাদের সহায়তায় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।

সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমেই কেবল আমরা মাদকের ভয়াবহ ছোবল থেকে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Share post:

spot_imgspot_img

Popular

More like this
Related

মাদকবিরোধী অভিযানে নীলফামারীতে কুখ্যাত বাশার আটক, পলাতক আরও দুই

আশীষ বিশ্বাস নীলফামারী প্রতিনিধি : নীলফামারীতে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের...

টেকনাফে র‍্যাবের সফল অভিযান: শীর্ষ সন্ত্রাসী শফি ডাকাত অস্ত্র-মাদকের পাহাড়ে আটক

ফরহাদ রহমান, টেকনাফ প্রতিনিধি টেকনাফের নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প-২৬ এর পাহাড়ি...

জেএসএস’র হাল ধরলেন আছিয়া আক্তার

“জাতীয় সাংবাদিক সংস্থা”র হাল ধরলেন প্রতিষ্ঠাতার সহধর্মিণী মোছা: আছিয়া...

সান্তাহারে ট্রেন দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু

সান্তাহারে ট্রেন দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু মৌ আকতারঃবগুড়ার আদমদিঘী উপজেলার...