ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী বীরেন্দ্র কুমার সরকার ১৯৭৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর জগন্নাথ হলে ছুরিকাঘাতে নিহত হন। প্রেমঘটিত বিরোধে সহপাঠী রণজিত মজুমদারকে দায়ী করা হলেও ৪৭ বছরেও মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি, আসামিও অধরা। এটি শুধু একটি ঘটনা নয়। স্বাধীনতার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অন্তত ৬০টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, যার বেশিরভাগই বিচারহীন থেকে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রতিবার তদন্ত কমিটি গঠন করে, মামলা হয়, অভিযুক্তদের কেউ কেউ ধরা পড়ে—কিন্তু অধিকাংশ মামলারই বিচার শেষ হয় না। সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছাত্রদল নেতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য খুনের ঘটনায় নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে: তদন্ত হয়, কিন্তু বিচার হয় না কেন?
অপরাধ বাড়ছে বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে
ঢাবির অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপারসন সহযোগী অধ্যাপক শাহরিয়া আফরিন বলেন, “প্রতিবারই তদন্ত কমিটি হয়, কিন্তু বিচার হয় না। সবাই ভুলে যায়, অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধকে উৎসাহ দিচ্ছে।”
বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক আরও এক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২০২৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, যখন ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় ২১ জন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে চার্জশিট হলেও, অনেকেই এখনো প্রকাশ্যে ঘুরছে। হত্যার ঘটনার পরপরই প্রশাসন কমিটি গঠন করে, তবে সেই তদন্তগুলোর বেশিরভাগই আলোর মুখ দেখে না।
ইতিহাসের পাতায় রক্তাক্ত অধ্যায়
ঢাবির ইতিহাসে ১৯৭৪ সালের মুহসীন হলের সাত ছাত্র হত্যা থেকে শুরু করে ১৯৮৫ সালে রাউফুন বসুনিয়া, ১৯৯০ সালে ডা. মিলন, ২০০৪ সালের ছাত্রদল নেতা খোকন, ২০১০ সালের আবু বকর সিদ্দিক—এইসব হত্যাকাণ্ডগুলোর বেশিরভাগেরই বিচার হয়নি বা অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
সাম্য হত্যায় প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
সাম্য হত্যাকাণ্ডের পর ঢাবি প্রশাসন কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। উদ্যানের নিরাপত্তা বাড়াতে গেট বন্ধ ও দেয়াল নির্মাণ, সিসিটিভি স্থাপন, নিয়মিত রেইড চালু ও পুলিশের জন্য বক্স স্থাপনের কথা জানানো হয়েছে। ঢাবি উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেন, “এই ঘটনার পরে আমাদের ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে। আরেকটা ঘটনা ঘটুক, সেটা আমরা চাই না।”
ছাত্রনেতাদের প্রতিক্রিয়া
ছাত্র সংগঠনগুলো বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে। ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, “ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে।”
ছাত্রদলের সভাপতি রাকিব বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ব্যর্থতাই এই হত্যাকাণ্ডগুলোর পেছনে দায়ী।”
শিবির সভাপতি এস এম ফরহাদ বলেন, “ফ্যাসিবাদী আমলে বিচারহীনতা ছিল, কিন্তু নতুন বাংলাদেশে তার কোনো জায়গা নেই।”
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক মোজাম্মেল হক বলেন, “প্রতিটি ঘটনার পর তদন্ত কমিটি হলেও, বিচার না হওয়ার কারণে এধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে।”
ঢাবির প্রক্টর ড. সাইফুদ্দিন আহমদ বলেন, “সাম্য হত্যার ঘটনায় তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে। তদন্ত চলছে। এবার আমরা শেষ পরিণতি দেখব।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে, কিন্তু বিচার হয় না বললেই চলে। তদন্তের পর বিচারের অভাবে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে, আর ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আশ্বাস থাকলেও শিক্ষার্থীরা বলছেন, বাস্তব পদক্ষেপ ছাড়া নিরাপত্তা ও বিচার নিশ্চিত হবে না।