তেহরান: ইসরায়েলের টানা ১২ দিনের সাঁড়াশি হামলা এবং যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আঘাতের পর ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে গেছে ইরানের রাজধানী তেহরানের স্বপ্ন ও আত্মবিশ্বাস। যুদ্ধের থাবায় আক্রান্ত এই মহানগর আবারও সচল হতে শুরু করলেও, তার বাসিন্দাদের চোখে এখনও পরিস্কার শঙ্কার ছায়া।
তেহরানের বিখ্যাত আজাদি টাওয়ারের পাদদেশে আয়োজিত এক উন্মুক্ত কনসার্টে দেশাত্মবোধক সুরে মুগ্ধ জনগণ মুহূর্তের জন্য ভুলে যেতে চেষ্টা করেছে যুদ্ধের ভয়াবহতা। সেখানেই তরুণী মিনা বলেন, “আমরা চেষ্টা করেছিলাম স্বাভাবিক জীবন গড়তে, কিন্তু যুদ্ধ সবকিছু ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। এখন মনে হয় ভবিষ্যৎটাই অন্ধকার।”
বোমার ছোবলে পুড়ে ছাই জাতীয় সম্প্রচার ভবন
১৬ জুন, ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন IRIB-এর মূল স্টুডিও ভবনে। আগুনে ছারখার হয়ে যায় ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, আলো, ট্রাইপড—সবকিছুই। এখন সেখানে শুধুই পুড়ে যাওয়া লোহা আর কাঁচের গুঁড়োর স্তূপ। ভবনের ছায়াঘেরা করিডোরে এখনও টিকে থাকা একমাত্র অফিসে সম্প্রচারিত হয় সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বক্তব্য।
“আমেরিকা চায় আমরা আত্মসমর্পণ করি,” বলেছেন ৮৬ বছর বয়সী খামেনি, যার ওপর এই কঠিন সময়ে জাতির দিকনির্দেশনার ভার।
ইসরায়েল দাবি করেছে এই টিভি কেন্দ্র থেকে সামরিক তৎপরতা পরিচালনা করা হচ্ছিল, যদিও সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকরা এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন। তাঁদের মতে, এ হামলা ছিল ইরানি জনগণের কণ্ঠ স্তব্ধ করার প্রচেষ্টা।
রাজধানীর হাসপাতালগুলোয় যন্ত্রণার চিত্র
ইভিন কারাগারে ইসরায়েলি হামলায় আহত হন ডজনখানেক বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তা। সেই আঘাতে আহত মরতেজা বলেন, “আমরা ছিলাম পরিবহন শাখায়, সরাসরি কোনও সংঘাতে জড়িত ছিলাম না। কিন্তু ওরা আমাদের ওপর হামলা করলো।” তার হাত ও শরীরের নিচের অংশে ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে বলেন, “যারা বলে শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা হয়েছে—তারা মিথ্যা বলছে।”
তালেগানি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্মরত নার্স আশরাফ বারঘির অভিজ্ঞতা হৃদয়বিদারক। “আমার ৩২ বছরের পেশাগত জীবনে এমন নিষ্ঠুর আহত মানুষ কখনও দেখিনি,” বলেন তিনি। “আমরা বিশ্বাস করতে পারছি না যে যুদ্ধ শেষ হয়েছে। মনে হচ্ছে আরেকটা হামলা আসন্ন।”
বাজার খুলছে, তবে আতঙ্ক গেছে না
জর্জরিত হলেও, তেহরান আবার হাঁটছে ছন্দে। দোকানপাট খুলছে, বাজারে ফিরছে ক্রেতা। বিখ্যাত গ্র্যান্ড বাজারে বেচাকেনা শুরু হলেও ব্যবসায়ীদের মুখে শঙ্কা—নতুন কোনও নিষেধাজ্ঞা বা সামরিক হস্তক্ষেপ যেন আবার সবকিছু স্তব্ধ করে না দেয়।
ক্যাফে বফ-এ বারিস্তা আমির বলেন, “নিষেধাজ্ঞা ব্যবসার শত্রু। আমরাও চাই আমরা পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারি। শুধু কফি নয়, আমাদের স্বপ্নও যেন ঠান্ডা হয়ে না যায়।”
তাঁর ক্যাফেটি অবস্থিত একসময়কার মার্কিন দূতাবাসের স্থানেই। এখনো দেয়ালে আঁকা আছে মার্কিনবিরোধী চিত্র—বিগত পাঁচ দশকের সম্পর্কের এক গভীর প্রতিচ্ছবি।
প্রতিরোধ এবং প্রত্যাশার দ্বন্দ্ব
যুদ্ধ-পরবর্তী এই সময়ে শহরের মানুষ কথা বলছেন স্পষ্টভাবে। আলি রেজা বলেন, “সরকারের উচিত জনগণের কথা শোনা। আমরা কেবল একটু স্বাধীনতা চাই, জীবনের জন্য কিছু আশা চাই।”
আর ১৮ বছর বয়সী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হামেদ বলেন, “আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সেনা আক্রমণ করে কোনো জাতিকে বাধ্য করা যায় না। এটা কূটনীতির পরাজয়।”
রক্তে দগ্ধ শহর, তবুও জীবনের আলোর খোঁজে নিরন্তর পথচলা
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই সংঘাতে ৬২৭ জন নিহত এবং প্রায় ৫০০০ জন আহত হয়েছে। হাজারো পরিবার হারিয়েছে প্রিয়জন, ঘরবাড়ি, জীবিকার উৎস।
তবে যুদ্ধের ছাই ভেদ করে ওঠা এক একটি মৃদু আভা—তেহরানের সংবেদনশীল, সাহসী, জীবন্ত মানুষগুলোই যেন তা প্রতিফলিত করে। যতবার আঘাত এসেছে, ততবার এই শহর আবার দাঁড়িয়েছে।